ঢাকা ও কলকাতা দুই শহর, তাদের শরীর আলাদা, আত্মা এক। সেই একাত্মা শহর কখন আলাদা হয়ে গেল রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদির আড়ালে কে তা জানে! তবে এটা সত্য, কলকাতার যে-কেউ ঢাকায় পা দিলে কিংবা ঢাকার যে কেউ কলকাতায় পা দিলে অন্তরের দৃশ্যপটে আলোড়ন ওঠে।
"It was the best of times, it was the worst of time…"
- Charles Dickens, A Tale of two cities
ঢাকা ও কলকাতা দুই শহর, তাদের শরীর আলাদা, আত্মা এক। সেই একাত্মা শহর কখন আলাদা হয়ে গেল রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদির আড়ালে কে তা জানে! তবে এটা সত্য, কলকাতার যে-কেউ ঢাকায় পা দিলে কিংবা ঢাকার যে কেউ কলকাতায় পা দিলে অন্তরের দৃশ্যপটে আলোড়ন ওঠে। পানিপুরি আর ফুচকার মিল-অমিলের আড়ালে চলতে থাকে দুই নগরের ইতিহাস ঐতিহ্যের ভেদাভেদ তত্ত¡। তানভীর মোকাম্মেলের প্রথম উপন্যাস ‘দুই নগর’ ঢাকা আর কলকাতা-কেন্দ্রিক। কলকাতার মেয়ে জয়তী চক্রবর্তী ঢাকা আসে ’৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে গবেষণার কাজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান তাকে এ গবেষণায় সহায়তা করেন। জয়তীর বাবা-মা একদা বাংলাদেশেই ছিলেন। সামন্ত জমিদার পরিবারের মেয়ে জয়তী এই সুযোগে নিজের পিতা-মাতার আদি আবাসটাও ঘুরে দেখে যায়। অকস্মাৎ এক বর্ষার রাতে সহযাত্রী রায়হানের সঙ্গে তার মিলন হলো। এই মিলন কি হিন্দু-মুসলমান, বাংলাদেশ-ভারতের মিলনের কোনো ইঙ্গিত না, তানভীর মোকাম্মেল কোনো সরল প্রেমের গল্পের আড়ালে আবেগি ইঙ্গিতে বিশ্বাসী নন। তাঁর ‘দুই নগরের’ কাহিনি হয়তো চার লাইনে বলা যায়, কিন্তু তার গভীরতা কাহিনির ছক-বাঁধা বলয় ছাড়িয়ে আরো দূর কোনো সীমান্তরেখায় ছুটে যায়।
কর্পোরেট কালচার, নারী স্বাধীনতা, যৌনতা, নৃতত্ত¡, জাতিসত্তা, ইতিহাস, অর্থনীতি, ধর্ম, রাজনীতি, মানবিকতা, মিডলাইফ ক্রাইসিস, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, শাহবাগ আন্দোলন এমনই-সব বিষয় চলে এসেছে ৯০ পাতার ছোটো পরিসরের ‘দুইনগর’ উপন্যাসে। বলা সঙ্গত, বিষয় আর ভাবনার দিক থেকে এই উপন্যাস মহাকাব্যিক। আকারে ছোটো এই উপন্যাসে জেনারেল দ্য গল, ফ্রান্সিস বেকন, গুজম্যান, গ্রামসি, ফুকো উঠে এসেছে রেফারেন্স হিসেবেই। উদ্ধৃতি দিতে গেলে অর্ধেকটা উপন্যাসের কথাই বলতে হয়; এই একটি উপন্যাস যার অন্তত অর্ধেক অংশ উদ্ধৃতিযোগ্য বিবেচনা করি। একই সঙ্গে ইতিহাস ও বর্তমান সমাজবাস্তবতা এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে সাবলীল দক্ষতায়। বার্ডস আই ভিউ নয়, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতিকে লেখক দেখেন আনুবীক্ষণিক ডিটেইলে। ফলে, উপন্যাসে প্রায়শই হিরকদ্যুতির মতো একেকটি বাক্য আলোকবিস্তারি।
তানভীর মোকাম্মেলের ঢাকায় বসবাস ও বেড়ে ওঠা। ঢাকাকে চেনেন তিনি হাতের তালুর মতোই। একসময়ের প্রাদেশিক রাজধানীকে তিনি দেখেছেন মেগাসিটির দিকে হাঁটতে। অন্যদিকে মহানগর কলকাতাও তার আয়াসসাধ্য গন্তব্য। বহুবার গিয়েছেন পেশাগত কিংবা ব্যক্তিগত নানান কাজে। কলকাতা তার কাছে প্রিয় পরিচিত শহর। এই দুই শহরের মিল ও ফারাক তাকে ভাবায়। সেই ভাবনার ছাপ পড়েছে এই উপন্যাসে। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞার পরিচয়ও পাই এই উপন্যাসে। দেশভাগের ক্ষত নিয়ে তার নির্মিতব্য নতুন প্রমাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’র গবেষণার কিছু অভিজ্ঞান ‘দুই নগর’ উপন্যাসে লক্ষ করা বিচিত্র নয়।
সমকালের বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্থানটি প্রকাশনার দিক থেকে এগিয়ে আছে। কিন্তু নান্দনিক কিংবা দায়বোধের স্থান থেকে বিবেচনা করলে আমাদের উপন্যাস কিছুটা ম্লান হয়ে আসে। নায়ক-নায়িকার প্রেম, ঘটনার ছড়াছড়ি, সংলাপের চাতুর্য, বর্ণনার কুশলতা এই সবের ভিড়ে কোথায় যেন আমাদের উপন্যাস পাঠের আনন্দের সীমাতেই আটকে থাকে। পাঠকের ভাবনা ও বোধে ঝাঁকি দেয়ার মতো উপন্যাস হয়তো জনপ্রিয় উপন্যাস-চর্চার ধারায় আমরা কমই পাই। সেই বিবেচনায়, নেহাতই বিনোদন-পিয়াসী বা সময় কাটানোর খোরাক হবে না তানভীর মোকাম্মেলের ‘দুই নগর’। তবে দুই বাংলার মানুষ, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মবোধ জানতে-বুঝতে, ভাবতে-ভাবাতে এই উপন্যাস হতে পারে মাইলফলক।
ঢাকা ও কলকাতা দুই শহর, তাদের শরীর আলাদা, আত্মা এক। সেই একাত্মা শহর কখন আলাদা হয়ে গেল রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদির আড়ালে কে তা জানে! তবে এটা সত্য, কলকাতার যে-কেউ ঢাকায় পা দিলে কিংবা ঢাকার যে কেউ কলকাতায় পা দিলে অন্তরের দৃশ্যপটে আলোড়ন ওঠে।
By তানভীর মোকাম্মেল
Category: উপন্যাস
"It was the best of times, it was the worst of time…"
- Charles Dickens, A Tale of two cities
ঢাকা ও কলকাতা দুই শহর, তাদের শরীর আলাদা, আত্মা এক। সেই একাত্মা শহর কখন আলাদা হয়ে গেল রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদির আড়ালে কে তা জানে! তবে এটা সত্য, কলকাতার যে-কেউ ঢাকায় পা দিলে কিংবা ঢাকার যে কেউ কলকাতায় পা দিলে অন্তরের দৃশ্যপটে আলোড়ন ওঠে। পানিপুরি আর ফুচকার মিল-অমিলের আড়ালে চলতে থাকে দুই নগরের ইতিহাস ঐতিহ্যের ভেদাভেদ তত্ত¡। তানভীর মোকাম্মেলের প্রথম উপন্যাস ‘দুই নগর’ ঢাকা আর কলকাতা-কেন্দ্রিক। কলকাতার মেয়ে জয়তী চক্রবর্তী ঢাকা আসে ’৪৭-এর দেশভাগ নিয়ে গবেষণার কাজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রায়হান তাকে এ গবেষণায় সহায়তা করেন। জয়তীর বাবা-মা একদা বাংলাদেশেই ছিলেন। সামন্ত জমিদার পরিবারের মেয়ে জয়তী এই সুযোগে নিজের পিতা-মাতার আদি আবাসটাও ঘুরে দেখে যায়। অকস্মাৎ এক বর্ষার রাতে সহযাত্রী রায়হানের সঙ্গে তার মিলন হলো। এই মিলন কি হিন্দু-মুসলমান, বাংলাদেশ-ভারতের মিলনের কোনো ইঙ্গিত না, তানভীর মোকাম্মেল কোনো সরল প্রেমের গল্পের আড়ালে আবেগি ইঙ্গিতে বিশ্বাসী নন। তাঁর ‘দুই নগরের’ কাহিনি হয়তো চার লাইনে বলা যায়, কিন্তু তার গভীরতা কাহিনির ছক-বাঁধা বলয় ছাড়িয়ে আরো দূর কোনো সীমান্তরেখায় ছুটে যায়।
কর্পোরেট কালচার, নারী স্বাধীনতা, যৌনতা, নৃতত্ত¡, জাতিসত্তা, ইতিহাস, অর্থনীতি, ধর্ম, রাজনীতি, মানবিকতা, মিডলাইফ ক্রাইসিস, দেশভাগ, মুক্তিযুদ্ধ, শাহবাগ আন্দোলন এমনই-সব বিষয় চলে এসেছে ৯০ পাতার ছোটো পরিসরের ‘দুইনগর’ উপন্যাসে। বলা সঙ্গত, বিষয় আর ভাবনার দিক থেকে এই উপন্যাস মহাকাব্যিক। আকারে ছোটো এই উপন্যাসে জেনারেল দ্য গল, ফ্রান্সিস বেকন, গুজম্যান, গ্রামসি, ফুকো উঠে এসেছে রেফারেন্স হিসেবেই। উদ্ধৃতি দিতে গেলে অর্ধেকটা উপন্যাসের কথাই বলতে হয়; এই একটি উপন্যাস যার অন্তত অর্ধেক অংশ উদ্ধৃতিযোগ্য বিবেচনা করি। একই সঙ্গে ইতিহাস ও বর্তমান সমাজবাস্তবতা এই উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে সাবলীল দক্ষতায়। বার্ডস আই ভিউ নয়, আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র, সংস্কৃতিকে লেখক দেখেন আনুবীক্ষণিক ডিটেইলে। ফলে, উপন্যাসে প্রায়শই হিরকদ্যুতির মতো একেকটি বাক্য আলোকবিস্তারি।
তানভীর মোকাম্মেলের ঢাকায় বসবাস ও বেড়ে ওঠা। ঢাকাকে চেনেন তিনি হাতের তালুর মতোই। একসময়ের প্রাদেশিক রাজধানীকে তিনি দেখেছেন মেগাসিটির দিকে হাঁটতে। অন্যদিকে মহানগর কলকাতাও তার আয়াসসাধ্য গন্তব্য। বহুবার গিয়েছেন পেশাগত কিংবা ব্যক্তিগত নানান কাজে। কলকাতা তার কাছে প্রিয় পরিচিত শহর। এই দুই শহরের মিল ও ফারাক তাকে ভাবায়। সেই ভাবনার ছাপ পড়েছে এই উপন্যাসে। অন্যদিকে তার রাজনৈতিক সচেতনতা ও প্রজ্ঞার পরিচয়ও পাই এই উপন্যাসে। দেশভাগের ক্ষত নিয়ে তার নির্মিতব্য নতুন প্রমাণ্যচিত্র ‘সীমান্তরেখা’র গবেষণার কিছু অভিজ্ঞান ‘দুই নগর’ উপন্যাসে লক্ষ করা বিচিত্র নয়।
সমকালের বাংলা সাহিত্যে উপন্যাসের স্থানটি প্রকাশনার দিক থেকে এগিয়ে আছে। কিন্তু নান্দনিক কিংবা দায়বোধের স্থান থেকে বিবেচনা করলে আমাদের উপন্যাস কিছুটা ম্লান হয়ে আসে। নায়ক-নায়িকার প্রেম, ঘটনার ছড়াছড়ি, সংলাপের চাতুর্য, বর্ণনার কুশলতা এই সবের ভিড়ে কোথায় যেন আমাদের উপন্যাস পাঠের আনন্দের সীমাতেই আটকে থাকে। পাঠকের ভাবনা ও বোধে ঝাঁকি দেয়ার মতো উপন্যাস হয়তো জনপ্রিয় উপন্যাস-চর্চার ধারায় আমরা কমই পাই। সেই বিবেচনায়, নেহাতই বিনোদন-পিয়াসী বা সময় কাটানোর খোরাক হবে না তানভীর মোকাম্মেলের ‘দুই নগর’। তবে দুই বাংলার মানুষ, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্মবোধ জানতে-বুঝতে, ভাবতে-ভাবাতে এই উপন্যাস হতে পারে মাইলফলক।